মেলবোর্নের সেই তিক্ত স্মৃতির পাঁচ বছর

প্রকাশিত হয়েছে - 2020-03-19T01:45:30+06:00
আপডেট হয়েছে - 2020-03-19T01:47:54+06:00
প্রত্যাশার ফানুশ উড়িয়ে ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল বাংলাদেশ। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা যখনই সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতেন, লক্ষ্য হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালের কথাই বলতেন। দারুণ পারফরম্যান্সে মাশরাফিরা সেই লক্ষ্য পূরণও করেছিলেন।

কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর অনেকে সেমিফাইনালের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন। শক্তিশালী
ের বিপক্ষে জয় অসম্ভব ছিল না, সেই সাথে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলছিল বড় পর্বে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সাফল্য আর ধারাবাহিক পারফরম্যান্স। ১৯ মার্চ, ২০১৫- মেলবোর্নের সেই কোয়ার্টার ফাইনালে অবশ্য বাংলাদেশ বরণ করে নেয় ১০৯ রানের পরাজয়। তবে পরাজয়ের ব্যবধানে যে কথাটি লেখা নেই- সেই ম্যাচে দৃষ্টিকটু পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ।





দৃষ্টিকটু না বলে একে ইতিহাসেরই সবচেয়ে বাজে আম্পায়ারিং হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। আম্পায়ারদের অন্তত তিনটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে একাধিকবার ম্যাচে ব্যাকফুটে চলে যায় বাংলাদেশ। ভুলগুলো ছিল যেন অমার্জনীয়। প্রভাবশালী ও বিখ্যাত দুই আম্পায়ার ইয়ান গোল্ড ও আলিম দারের একপেশে সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশের সমর্থকদের এতটাই ক্ষুণ্ণ করেছিল যে, দেশের কোথাও কোথাও দাহ করা হয় তাদের কুশপুত্তলিকা। সমর্থকরা রাজপথে নেমেছিলেন আইসিসির সমালোচনায়।

অবিশ্বাস্যভাবে বিলুপ্তি ঘটলেও, 'বি থ্রি তত্ত্ব'কে তখন অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে ভারত। ক্রিকেটে দেশটির প্রভাব তাই স্পষ্ট ছিল। সেই প্রভাবই বাংলাদেশের বিপক্ষে গাঢ় হয়ে ফুটে উঠেছিল বলে মনে করা হয়। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ভারতের জয়ই ছিল বেশি অনুমেয়। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্দান্ত ক্রিকেট আসরের পরাশক্তিদের ভড়কে দিয়েছিল। যদিও জঘন্য আম্পায়ারিংয়ের শিকার হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। আম্পায়ারদের বিমাতাসুলভ আচরণই বাংলাদেশকে ঐ ম্যাচে পরিণত করেছিল নখদন্তহীন বাঘে।






আম্পায়ারের একটি বাজে সিদ্ধান্তই যেকোনো দলকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিতে পারে, সেই জায়গায় বাংলাদেশের বিপক্ষে বাজে সিদ্ধান্ত এসেছিল তিনটি! বিতর্কের শুরু ভারতের ইনিংসের ৩৪তম ওভারে। রোহিত শর্মার সাথে রান নেওয়ার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করছিলেন সুরেশ রায়না। মাশরাফির করা ঐ ওভারের একটি বল রায়নার ডান পায়ে এসে লাগে। ব্যাটসম্যান রায়নার দুটি পা-ই তখন ছিল স্ট্যাম্প বরাবর, সহজ দৃষ্টিতে যেটি দেখলে যে কারোরই আউট বলে মনে হবে। মাশরাফিরা উইকেটের জন্য আবেদন করলে নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ইংলিশ আম্পায়ার ইয়ান গোল্ড তা নাকচ করে দেন। সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না হয়ে মাশরাফিরা রিভিউ আবেদন করেন।
রিভিউয়ের সময় টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, বলটি সরাসরি স্ট্যাম্পে আঘাত করছে। মাশরাফির বলটি পিচের যে জায়গায় স্পর্শ করেছিল, তার অন্তত অর্ধেক অংশ উইকেট-টু-উইকেট এরিয়ার মধ্যে; বাকি অংশ বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে টিভি আম্পায়াররা আউটের ঘোষণা দিলেও ম্যাচ রেফারী স্টিভ ডেভিস তা না করে ব্যাটসম্যানের পক্ষে রায় দেন। প্রশ্ন ওঠে- স্বাভাবিক অবস্থায় যে ডেলিভারিতে ফিল্ড আম্পায়ার দ্বিধাহীনভাবে আঙুল তুলে দেন, সেক্ষেত্রে এখানে কেন নাকচ করে দিলেন ইয়ান গোল্ড।
বিশ্বখ্যাত ক্রিকেট সংবাদমাধ্যম ইএসপিএনক্রিকইনফো এই 'অঘোষিত আউট' সম্পর্কে লিখেছিল- ‘এটা অনেক বেশি ক্লোজড কল ছিল। ৫১ শতাংশই আউট।’ ভারতীয় ধারাভাষ্যকার সঞ্জয় মাঞ্জরেকারও বলেছিলেন, ‘নিয়মের দিক থেকে সিদ্ধান্তটা ঠিক, নীতির দিক থেকে ঠিক নয়।’

বাংলাদেশ দ্বিতীয় অনিয়মের শিকার হয় ভারতের ইনিংসের ৪০তম ওভারে। ম্যাচসেরা রোহিত শর্মা তখন ব্যাট করছেন ৯০ রান নিয়ে। রুবেলের করা ফুলটস উড়িয়ে মেরেছিলেন, বলটি সুনিপুণ দক্ষতায় তালুবন্দী করেন ইমরুল কায়েস। কিন্তু বাংলাদেশ উদযাপন শুরু করার বেশ কিছু সময় পর হঠাৎ আম্পায়ার ইয়ান গোল্ড একহাত প্রসারিত করে জানান দেন- বলটি নো বল ছিল! এলবিডব্লুর রিভিউ করে সফল না হওয়ায় মাশরাফিদের হাতে কোনো রিভিউ ছিল না, তাই আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করারও কোনো সুযোগ ছিল না।
এ নিয়ে বিবিসির টেস্ট ম্যাচ স্পেশালিস্ট জোনাথন অ্যাগনিউ ম্যাচ চলাকালেই বলেছিলেন, ‘শেষ অবধি হয়তো এটা ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যাবে। আমার মনে হয়, রোহিম শর্মা জেনুইনলি আউট হয়েছেন। ম্যাচের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়াবে এবং এটা নিয়ে লম্বা সময় বিতর্ক চলবে।’
সত্যিই তাই হয়েছিল! টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, বল রোহিতের কোমরেরও নিচে অবস্থান করে ব্যাটে লেগেছে। এছাড়া রোহিত শর্মা তখন স্ট্রাইকিং প্রান্তের সীমানার বাইরে ছিলেন, সেক্ষেত্রে বল কোমরের উপরে অবস্থান করলেও 'নো বল' ধরার এখতিয়ার নেই আম্পায়ারের। কিন্তু লেগ আম্পায়ার আলিম দার ও সেই সাথে ইয়ান গোল্ডের বিতর্কিত ও হাস্যকর সিদ্ধান্তে সেই রোহিত শর্মা নিজের ইনিংস টেনে নেন ১৩৭ রানে!

ভুল সিদ্ধান্ত ছিল ৩০৩ রানের লক্ষ্যে ছোটা বাংলাদেশের ইনিংসেও। দুই ওপেনারকে দ্রুত হারিয়ে চাপে পড়ে গেলে বাংলাদেশের হাল ধরেন আগের দুই ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। সৌম্য সরকারকে সঙ্গে নিয়ে বেশ ভালোভাবে এগোচ্ছিলেন। কিন্তু আম্পায়ারের একটি ভুল সিদ্ধান্ত রিয়াদকে প্যাভিলিয়নে পাঠানোর পাশাপাশি ম্যাচ থেকেও ছিটকে দেয় বাংলাদেশকে।
মোহাম্মদ শামির ছোঁড়া শর্ট বলে রিয়াদ তুলে মারলে তা তালুবন্দী করেন শিখর ধাওয়ান। তবে বল হাতে থাকা অবস্থায় তিনি বাউন্ডারি লাইনের স্পর্শে ছিলেন কি না তা নিয়ে সংশয় থাকায় টিভি আম্পায়ার পল রাইফেলের সহায়তা নেন দুই ফিল্ড আম্পায়ার। টিভি রিপ্লেতে দেখে মনে হয়েছিল, বল তালুবন্দী করার মুহূর্তে ধাওয়ানের পা বাউন্ডারি লাইনের সংস্পর্শেই ছিল। কিন্তু আম্পায়ার 'আউট' বলে ঘোষণা করলে ম্যাচ থেকে একরকম ছিটকেই যায় টাইগাররা।
'বরণীয়' না হলেও, ক্রিকেট বিশ্বের কাছে সেই ম্যাচ স্মরণীয় অনেক কারণেই। বিশ্বকাপের সেই ম্যাচ থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয় মনস্তাত্ত্বিক বৈরিতা ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ক্রিকেটে এমন পক্ষপাতমূলক আচরণে বাংলাদেশের মত ক্ষুব্ধ হয়েছিল গোটা ক্রিকেট অঙ্গন। এমনকি ভদ্রলোকের খেলা, স্বচ্ছতার খেলা ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়েও দেখা দিয়েছিল সংশয়!